
সম্মানজনক পরিসমাপ্তি
ছোটবেলার এক মাগরিবের সময়ের কথা এখনো চোখে ভাসে। বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদা—এক হাতে লাঠি, চোখে অপার স্নেহ। প্রতিদিন এমন করেই দাঁড়িয়ে থাকতেন, শুধু আমাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার পরিবারটা তখনও ছিল সেকুলার ভাবধারার; নামাজ, রোযা, ইসলামী পরিবেশ—এসব যেন ছিল দূরের জিনিস। কখনো কোনো পারিবারিক সমস্যায় পড়ে কেউ হয়তো মসজিদের বারান্দা অব্দি গেছে, তবে সিজদায় মাথা ঠেকানো—তা ছিল না বললেই চলে। আজ যে আমার মাঝে নামাজের প্রতি যেটুকু মায়া, দুইটা সিজদার অভ্যাস—তা দাদার হাত ধরেই শুরু।
নিজের দাদাকে আমি চোখে দেখিনি। আমার জন্মের আগেই আল্লাহ তাঁকে ডেকে নিয়েছেন তাঁর কাছে। তাই দাদার আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি বড় দাদার কাছ থেকে—একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, যাঁর জীবনজুড়ে ছিল মেহনত, সাদাসিধে চলাফেরা আর দীনের প্রতি এক অটল ভালোবাসা।
তিনি তাঁর জীবনের সঞ্চয়, সাধ্য, সবকিছু ঢেলে দিয়েছিলেন নিজের একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু নিয়তি যেন নির্মম খেলাই খেলল—ছেলে বখে গেল, বাবার সেই ভালোবাসা আর ত্যাগের মর্যাদা দিতে পারল না একটুও।
তবে দাদার পথ ছিল আলাদা, একেবারে ব্যতিক্রম। যখনই কোনো হালাকা, কোনো দীনি মজলিস হত, দাদাকে সেখানেই পাওয়া যেত—আর সঙ্গে থাকতাম আমি, তাঁর ছায়া হয়ে, তাঁর হাতে হাত রেখে, তাঁর লাঠির মতো ভরসা হয়ে।
সবচেয়ে বেশি যেটা মনে পড়ে, তা হলো দাদার জীবনের একমাত্র বড় তামান্না—একবার আল্লাহর ঘর, কা‘বাঘর বায়তুল্লাহর যিয়ারত করা। নিজের যতটুকু সঞ্চয় ছিল, তা আর নিকট আত্মীয়দের সহযোগিতায় আল্লাহ তাঁর সেই তামান্না পূরণ করে দিয়েছিলেন। এখনো মনে পড়ে, যেদিন দাদা হজের ভিসা পেয়েছিলেন—সেদিন তাঁর হাসিমাখা, উজ্জ্বল মুখটা যেন কোনো নূরের ছায়া হয়ে জ্বলজ্বল করছিল। এরপর কখনোও তাঁকে সেভাবে হাসতে দেখিনি।
ভিসা পাওয়ার পর থেকেই আমাদের বাসায় যেন এক উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছিল। চারপাশে খুশির বাতাস বইছিল। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী—সবাই দাদার সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন, দোয়া চাইতে আসছিলেন। দাদাও হাসিমুখে সবাইকে বরণ করছিলেন। জীবনে একবার বায়তুল্লাহর সফর—এমন সৌভাগ্য তো আর সবার হয় না।
স্মৃতির পাতায় এখনো ঝকঝক করে জ্বলছে সেদিনের সন্ধ্যাটা—যেদিন দাদার হজে রওনা দেওয়ার আগের দিন। ঘরে এক বৃদ্ধ এসেছিলেন, দাদার বহু পুরোনো বন্ধু। চৌকাঠ পেরোনোর আগেই বলে উঠলেন, “কই রে, হাজি সাহেব কোথায়?”—এই একটুখানি বাক্যই যেন আমার হৃদয়টা কেঁপে তুলেছিল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল—যা কোনো শব্দে বোঝানো যায় না। তখনই ভেতরে ভেতরে বুঝে গিয়েছিলাম, আল্লাহ যাকে ইজ্জত দেন, সেই প্রকৃত সম্মানিত।
পরদিন ফজরের নামাজের পর দাদা রওনা দিলেন। চারপাশের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, এলাকার সবাই আমাদের বাসায় ভিড় করল দাদাকে বিদায় জানাতে। বাসার উঠোনে যেন মানুষের ঢল নামল। দাদা তখন চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। আমরাও পারিনি।
মুহূর্তটা ছিল আনন্দময়, কিন্তু দাদার মুখে একটা অদ্ভুত ভার দেখা যাচ্ছিল। হাসিমুখে থাকলেও, চোখের ভাষা বলছিল কিছু একটা। দাদা বারবার চেয়ে দেখছিলেন আমাদের দিকে—চেনা মুখ, আপন মুখ, আপন ঘরদুয়ার। যেন কিছু ধরে রাখতে চাইছেন, কিছু বিদায় দিতে পারছেন না।
ইশ, সেদিন যদি বুঝতে পারতাম!
মক্কায় পৌঁছানোর পর থেকেই দাদার সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ হচ্ছিল না। উনি এমনিতেই মোবাইল বা ডিভাইসে খুব কম সময় দিতেন, তাই আমাদের পক্ষ থেকেও বেশি বিরক্ত করা হয়ে ওঠেনি। তবে আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের পরিচিত কয়েকজন হাজি সেখানে থাকায় দাদার খোঁজখবর রাখা কিছুটা সহজ হয়েছিল। তাঁদের মাধ্যমেই জানতাম, দাদা ইবাদতে গভীরভাবে মগ্ন হয়ে গিয়েছেন। হজের প্রতিটি আহকাম যেন যথাযথভাবে আদায় করতে পারেন—এই নিয়তেই ছিলেন সর্বদা ব্যস্ত। দাদার সঙ্গী হাজিরা, যাঁদের সাথে আমাদের পরিচয় ছিল, তাঁরা প্রায়ই দাদার অবস্থা জানাতেন।
৮ই জিলহজ, হজের আনুষ্ঠানিক শুরুর দিন—সেদিনই আমাদের প্রথম ভিডিও কলে কথা হয় দাদার সঙ্গে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— “দাদা ভাই, শরীর কেমন আছে?”
তিনি হেসে বললেন,
— “আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই আছি। তবে অতিরিক্ত হাঁটার কারণে পায়ে একটা ছোট ফোড়া উঠেছে। চিন্তার কিছু নেই দাদু ভাই, ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তুমি আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না।”
এরপরদিন হঠাৎ দাদির ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। অপরপ্রান্তে কণ্ঠটা ভার, চাপা স্বরে কেউ জিজ্ঞেস করলেন,
— “আনোয়ার ভাইয়ের বাসা কি এটিই?”
দাদি উত্তর দিলেন,
— “জি হ্যাঁ।”
— “আমি উনার রুমমেট বলছি। বাসায় কোনো পুরুষ মানুষ আছেন?”
দাদি সাথে সাথে চাচাকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন। চাচা ফোন কানে দিতেই হঠাৎ থেমে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর যেন এক ধাক্কায় সব শব্দ থেমে গেল চারপাশে। তাঁর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল মেঝেতে। তারপর কেবল একটা বাক্যই ভেসে এল তাঁর মুখ থেকে—
— “আম্মা… আব্বা তো আর নেই…”
সব কিছু মুহূর্তে থেমে গেল। সময় থমকে দাঁড়াল। সেই একটা ফোনকল, সেই একটা খবর…
দাদার মৃত্যুর কারণ ছিল সেই ছোট্ট ফোড়াটা। ব্যথাটা রাতারাতি ভয়াবহ রূপ নেয়। আমি বিস্ময়ে হতবাক! এমন একটি ক্ষুদ্র ফোঁড়াও যে কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে—সুবহানাল্লাহ! কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আল্লাহর হিকমাহ এবং কুদরতের পরিপূর্ণতা আমি উপলব্ধি করি তখন, যখন দাদার লাশ দেশে আনার প্রসঙ্গ ওঠে।
দাদা ইন্তেকাল করেন হজের মূল আহকাম পালনের একেবারে আগের দিন। সারাজীবনের আরাধ্য স্বপ্ন যেন অধরা থেকে যায়। তবু, আল্লাহ তাঁকে এমন এক মর্যাদা দান করেন, যা হয়তো সে স্বপ্ন থেকেও বড়। সিদ্ধান্ত হয়, দাদার লাশ আর দেশে ফিরিয়ে আনা হবে না। সৌদি কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী দাদার গোসল ও জানাজার ব্যবস্থা হয় হারামের আঙিনায়। শত শত হাজি দাদার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।
শেষমেশ দাদার দাফন হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জমিনে—আল্লাহর ঘর কা’বার সান্নিধ্যে, যেখানে পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর ইতিহাস বিজড়িত স্মৃতি আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র পায়ের ছাপ লেগে আছে।
কি উত্তম মৃত্যু! কী সম্মানজনক পরিসমাপ্তি!
হ্যাঁ, দাদা হয়তো পুরো হজ সম্পন্ন করতে পারেননি, কিন্তু আল্লাহ তো আমাদের অন্তরের খবর জানেন। তিনি নিয়তের গুরুত্ব দেন। যেমন কেউ যদি ফরজ সালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদের পথে রওনা হয় এবং কোনো কারণে জামাত মিস করে—তবুও সে নিয়তের কারণে পূর্ণ সওয়াব পায়। ইনশাআল্লাহ, দাদাও পাবেন হজে মাবরুরের সওয়াব।
জান্নাতে পা রাখার সাথে সাথেই দাদার জীবনের সকল কষ্ট মুছে যাবে—যেমন কোনো ছাত্র পরীক্ষায় ভালো ফল করলে প্রস্তুতির ক্লান্তি ভুলে যায়।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম মৃত্যুর জন্য দোয়া করতেন। আর যদি সেই মৃত্যু হয় বায়তুল্লাহর ছায়ায়, তাহলে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মৃত্যু আর কী হতে পারে?
اللهم إني أسألك حسن الخاتمة
“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাচ্ছি একটি উত্তম পরিসমাপ্তি।”