
মুুহাররমের সিয়ামের গুরুত্ব
আমরা বাঙালিরা একটু আরামপ্রিয় জাতি, তাই না? ছুটির দিন পেলে জম্পেশ একটা ঘুম আর সাথে এক প্লেট গরম লুচি-আলুভাজি – এর থেকে আনন্দ আর কীসে! কিন্তু এই যে আমাদের ক্যালেন্ডারে মাঝে মাঝেই কিছু বিশেষ দিন আসে, সেগুলো নিয়ে আমরা কতটা ভাবি? ধরুন, মুহাররম মাস। এই মাসটা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমরা কি একবারও খেয়াল করে দেখেছি? শুধু নতুন বছরের শুরু আর একটা সরকারি ছুটি? নাহ, ব্যাপারটা এত সরল নয়। এই মাসটা আসলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটা বিশেষ উপহার, বিশেষ করে সিয়াম বা রোজা রাখার ক্ষেত্রে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিনটি, তা হলো আশুরা।
ঐতিহাসিক রিইউনিয়ন!
আজ থেকে বহু বছর আগে, মিশরে এক অত্যাচারী রাজা ছিল – নাম তার ফেরাউন। এই লোকটা নিজেকে দেবতা ভাবতো আর নিরীহ মানুষদের উপর কী যে অত্যাচার না করতো! তার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকতো। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা পাঠালেন তাঁর এক প্রিয় নবীকে – মুসা (আ.)। মুসা (আ.) বনি ইসরাঈলদের নিয়ে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বাঁচতে চাচ্ছিলেন। ফেরাউনও নাছোড়বান্দা, সে তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুসা (আ.)-কে ধাওয়া করলো। পথিমধ্যে পড়লো খরস্রোতা নীলনদ। সামনে অথৈ জল, পেছনে মৃত্যু! কী হবে এখন?
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো আছেন! তিনি মুসা (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করতে। আর অমনি কী আশ্চর্য কাণ্ড! নীলনদের বুক চিরে রাস্তা হয়ে গেল। মুসা (আ.) আর তার সঙ্গীরা হেঁটে পার হয়ে গেলেন। আর যখন ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে সেই পথেই ঢুকলো, আল্লাহ তায়ালা পানিকে আবার এক করে দিলেন। ব্যস, ফেরাউন আর তার দলবল সব নীলনদের অথৈ জলে বিলীন!
এটা শুধু একটা ঘটনা নয়, এটা ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটা বিজয়! মুসা (আ.) এই দিনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে রোজা রাখতেন। কারণ, এটা ছিল জালেমের উপর মজলুমের বিজয়, মিথ্যার উপর সত্যের বিজয়।
আর আমাদের প্রিয় নবী, মুহাম্মদ (সা.) যখন মদিনায় গেলেন, তখন তিনি দেখলেন ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখে। তিনি কারণ জানতে চাইলে তারা বললো, “এই দিনে আল্লাহ মুসা (আ.)-কে বাঁচিয়েছিলেন।” তখন আমাদের নবী (সা.) কী বললেন জানেন? তিনি বললেন, “মুসা (আ.)-এর ব্যাপারে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার!” মানে হলো, মুসা (আ.)-এর এই বিজয়ে আনন্দ করার অধিকার আমাদেরই বেশি! এরপর থেকে তিনিও আশুরার রোজা রাখা শুরু করলেন এবং সাহাবিদেরও বললেন এই রোজা রাখতে। ব্যাপারটা তো বেশ দারুণ, তাই না? একটা ঐতিহাসিক রিইউনিয়নের মতো!
আমরা কি কারবালার প্রেক্ষাপটে আশুরার সিয়াম রাখি?
একটি ভুল ধারণা ও তার নিরসন।
মুহাররম মাস এলেই একটি প্রশ্ন প্রায়শই সামনে আসে: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত কি ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের কারণে আশুরার সিয়াম পালন করে? এই বিষয়ে অনেকের মধ্যেই একটি ভুল ধারণা বিদ্যমান। সরল উত্তর হলো, না। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত কারবালার শাহাদাতের শোক স্মরণে আশুরার সিয়াম পালন করে না, বরং এই সিয়ামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং সুদূরপ্রসারী।
এই সিয়াম মূলত আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য রাখা হয়, কারণ এই দিনেই আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী মূসা (আ.) এবং বনি ইসরাঈলকে অত্যাচারী ফেরাউন ও তার বাহিনীর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা করেছিলেন। ফেরাউন তার বিশাল বাহিনী নিয়ে মূসা (আ.)-কে ধাওয়া করলে আল্লাহ তায়ালা নীলনদের বুক চিরে রাস্তা করে দেন এবং মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে পার হয়ে যান। এরপর ফেরাউন তার সৈন্যদল নিয়ে সেই পথেই প্রবেশ করলে আল্লাহ পানিকে আবার এক করে দেন এবং ফেরাউন ও তার দলবল নীলনদে ডুবে যায়।এই ঐতিহাসিক বিজয়ের স্মরণে এবং আল্লাহ তায়ালার প্রতি শুকরিয়াস্বরূপ মূসা (আ.) আশুরার দিনে সিয়াম পালন করতেন।
যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি দেখতে পান যে ইহুদিরাও এই দিনে সিয়াম পালন করছে। কারণ জানতে চাইলে তারা জানায় যে, এই দিনে আল্লাহ মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “মূসা (আ.)-এর ব্যাপারে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার।” (সহীহ বুখারী, মুসলিম)। এরপর থেকে তিনি নিজেও আশুরার সিয়াম পালন করেন এবং সাহাবিদেরও পালনের নির্দেশ দেন। এই হাদিস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আশুরার সিয়ামের মূল কারণ মূসা (আ.)-এর বিজয় এবং আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ইসলামের ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা। ৬১ হিজরীর মুহাররম মাসের ১০ তারিখে কারবালার প্রান্তরে তাঁর শাহাদাত মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর শোকের দিন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারীরা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করে এবং তাঁর শাহাদাতকে মুসলিম ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে গণ্য করে।
তবে, তাঁর শাহাদাতের শোক স্মরণে আশুরার সিয়াম পালন করা হয় না। শোক প্রকাশের পদ্ধতি হিসেবে ইসলামে সিয়াম পালনের কোনো নির্দেশনা নেই। বরং, ইসলামে শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং অনৈসলামিক রীতিনীতি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিয়াম হলো একটি ইবাদত, যা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি এবং নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে করা হয়।
যদি কারবালার ঘটনার কারণে আশুরার সিয়াম পালিত হতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশাতেই এই সিয়াম পালন করতেন এবং এর কারণ হিসেবে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের পূর্বাভাস উল্লেখ করতেন। তাঁর থেকে অধিক আর কেও ভালোবাসা রাখেন না ইমাম হুসাইন (রা,) এর প্রতি। কিন্তু হাদিসে এর কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং, হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, আশুরার সিয়াম সেই সুদূর অতীতে মূসা (আ.)-এর সময় থেকেই চলে আসছে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহুদিদের দেখাদেখি নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ও মূসা (আ.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণের অংশ হিসেবেই এই সিয়ামকে মুসলিমদের জন্য সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য পরিহারের গুরুত্ব
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য পরিহারের জন্য আশুরার সিয়ামের সাথে আরও একটি সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যদি আমি আগামী বছর জীবিত থাকি, তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখেও সিয়াম পালন করব।”
(সহীহ মুসলিম)
। এর উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিরা যেহেতু শুধু ১০ তারিখে সিয়াম পালন করতো, তাই মুসলিমরা ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে সিয়াম পালন করে তাদের থেকে পার্থক্য সৃষ্টি করবে। একে তাসুয়া (৯ তারিখ) ও আশুরা (১০ তারিখ) বলা হয়। এটি প্রমাণ করে যে, এই সিয়াম একটি সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও শরীয়তসম্মত কারণে পালিত হয়, কোনো সাম্প্রতিক শোকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতে ব্যথিত হলেও, আশুরার সিয়ামকে কারবালার ঘটনার সাথে সংযুক্ত করে না। আশুরার সিয়াম হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মূসা (আ.)-কে দেওয়া বিজয় এবং ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তির স্মারক। এটি বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হয় এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিরাট রহমত। তাই, এই ভুল ধারণা দূর করে আমাদের সিয়াম পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বোঝা উচিত এবং সুন্নাহ অনুযায়ী এই মহিমান্বিত ইবাদতটি পালন করা উচিত।
এক বছরের গুনাহ মাফ?
এখন আসি আসল আকর্ষণীয় তথ্যে! আশুরার রোজা রাখলে কী হয়? নবীজি (সা.) বলেছেন: “রমজানের সিয়ামের পর শ্রেষ্ঠ সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের সিয়াম।” (সহীহ মুসলিম)
আর আশুরার দিনের রোজা সম্পর্কে তো আরও অবাক করা কথা আছে: “আশুরার দিনের সিয়ামের ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে।”
(সহীহ মুসলিম)
ব্যাপারটা ভাবুন তো! মাত্র একটা রোজা, আর তাতেই নাকি গত এক বছরের ছোট ছোট গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা! এটা তো লটারিতে জ্যাকপট জেতার চেয়েও বেশি কিছু! আল্লাহ তায়ালার এমন উদারতা দেখে সত্যি অবাক হতে হয়।
শুধু আশুরা নয়, পুরো মাসটাই স্পেশাল!
মুহাররম মাসটাকেই ‘আল্লাহর মাস’ বলা হয়েছে। তার মানে কী? এই মাসে শুধু আশুরা নয়, যেকোনো দিন নফল রোজা রাখলেই তাতে বিশেষ সওয়াব পাওয়ার আশা করা যায়। যারা একটু বেশি বেশি নেকি কামাতে চান, আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে চান, তাদের জন্য এই মাসটা হলো একটা চমৎকার সুযোগ। একটু চেষ্টা করলেই এই মাসে আমরা আমাদের আমলনামা ভারী করে নিতে পারি।
শেষ কথা
তো কী ভাবছেন? মুহাররমের সিয়াম, বিশেষ করে আশুরার সিয়াম, আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত আর ক্ষমা পাওয়ার এক দারুণ রাস্তা খুলে দেয়। একদিকে বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ, অন্যদিকে নবীজির (সা.) সুন্নত অনুসরণ, আর তার সাথে একটা ঐতিহাসিক ঘটনার শিক্ষা – কী নেই এতে!
এটা আসলে খুব বেশি কঠিন কোনো কাজ নয়। সিয়াম রাখা তো আমাদের অভ্যস্ত একটা ব্যাপার। শুধু একটু সদিচ্ছা আর প্রস্তুতি!
বলুন তো, এই সুযোগটা কি আমরা হাতছাড়া করতে পারি? মুহাররমের সিয়াম পালনের জন্য কি আপনার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে?