ধর্মীয়ভাবে কুরবানির গুরুত্ব

ধর্মীয়ভাবে কুরবানির গুরুত্ব

যাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তারা কি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করতে পারবে?

আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনাগুলোতে আমরা জেনেছি কাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে কুরবানি ফরজ হওয়ার শর্তগুলো কী কী। এখন প্রশ্ন হলো, যেহেতু কুরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয় এবং কুরবানির দিন আল্লাহর কাছে এটিই সবচেয়ে প্রিয় আমল, তাহলে যাদের উপর এই বিধান প্রযোজ্য নয়, অর্থাৎ যাদের সামর্থ্য নেই বা অন্যান্য শর্ত পূরণ হয় না, তারাও কি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানি করতে পারবে?

হ্যাঁ, অবশ্যই পারবে। যাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তারাও নফল কুরবানি হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানি করতে পারে। ইসলামী শরীয়তে এটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচিত।

কুরবানি মূলত দুটি কারণে করা হয়:

  • ওয়াজিব বা ফরয বিধান পালনের জন্য: যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক এবং অন্যান্য শর্ত পূরণ করে, তাদের জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি বাধ্যবাধকতা।
  • আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য (নফল): যাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তারাও চাইলে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানি করতে পারে। এটি তাদের জন্য একটি অতিরিক্ত পুণ্যময় আমল। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে, ঠিক যেমনভাবে একজন ব্যক্তি নফল নামাজ বা নফল সাদকা করে থাকেন। ইসলামে যেকোনো ভালো কাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হলে তা পুরস্কৃত হয়। কুরবানি যেহেতু একটি মহান ইবাদত, তাই ওয়াজিব না হলেও যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এটি করে, তবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই প্রতিদান দেবেন।

 

কুরবানি কেবল একটি বিধান নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি আমাদের অনন্য ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যম। এটি তাওহীদের সুন্দর দৃষ্টান্তও বলা যায়। একটু কল্পনা করুন, আপনি ঈদের কিছুদিন আগে একটি উট, দুম্বা, ছাগল অথবা গরু কিনলেন। আল্লাহর সৃষ্টি এই জীবের প্রতি আমাদের যত্ন এবং ভালোবাসা তখন আরও বৃদ্ধি পায়। শুনতে হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যিই আপনি এক অদ্ভুত ধরনের  প্রশান্তি অনুভব করবেন। কারণ, আল্লাহ নিজেই ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম)-কে আদেশ করেছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করতে।

এবার আপনার নিয়তের কথা চিন্তা করুন: আপনি কুরবানি করছেন শুধু আল্লাহর জন্য, আর কারো জন্য নয়। দুনিয়ার মানুষ আপনাকে ধার্মিক বলবে, পুণ্যবান বলবে—এই জন্য নয়। কারণ আপনি জানেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু—সবকিছুই আল্লাহরই জন্য, যিনি সকল জগতের পালনকর্তা।” (সূরা আল-আন‘আম, আয়াত ১৬২)

আপনি গোশত খাওয়ার জন্যও কুরবানি করেননি, কারণ আপনার উপর তো এটা ওয়াজিব ছিল না। আপনি করেছেন কারণ আপনার রব দেখছেন আপনি যা করছেন শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য। কারণ আপনি এটাও জানেন,

لَنْ يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ
“তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছে।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৩৭)

বলুন, এর থেকে আর বড় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আর কী হতে পারে? এটাই তাওহিদ—একত্ববাদ। আল্লাহর জন্যই আমাদের সব কিছু। কুরবানির এই আমলটি হতে পারে আপনার অন্তরকে বিশুদ্ধ করে তাওহিদের দিকে প্রত্যাবর্তনের এক অনন্য সুযোগ। এর জন্য ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পূরণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। নফল ইবাদতের মাধ্যমেই আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়।
যেমনটি সহীহ বুখারিতে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

“…আর সে ক্রমাগত নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে, অবশেষে আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করি…” (সহীহ বুখারি, হাদীস: ৬৫০২)

এই হাদীস আমাদের শেখায়, ফরয ইবাদতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর আদেশ পালন করি, আর নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করি।

তবে, এখানে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, নফল কুরবানি করার জন্য নিজেকে কষ্ট বা ঋণী করার প্রয়োজন নেই। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং আন্তরিকতার সাথে এই আমলটি করাই কাম্য।

Back to blog