
জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের আমল: ২য় পর্ব
৮) কিয়ামুল লাইল
কিয়ামুল লাইল হলো রাতের নির্দিষ্ট অংশে জেগে নফল সালাত আদায় করা, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়মিত আমল ছিল। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি রাসূলুল্লাহকে কখনও রাতের সালাত ত্যাগ করতে দেখিনি।” (সহিহ বুখারি: 1147, সহিহ মুসলিম: 738)
কিয়ামুল লাইল আদায়কারীদের জন্য জান্নাতে স্বচ্ছ দেয়ালের প্রাসাদ প্রস্তুত রয়েছে, এবং তাঁদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। আল্লাহ বলেন,
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“কেউ জানে না তাঁদের আমলের প্রতিদানস্বরূপ কী অসাধারণ নয়নাভিরাম পুরস্কার লুকিয়ে রাখা আছে।” (সূরা আস-সাজদা, আয়াত: ১৭)
হাসান আল-বাসরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “গুনাহ ছাড়া আর কিছুই রাতের সালাত থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে না।” (হিলইয়াতুল আওলিয়া, ২/১৩৪) অতএব, কিয়ামুল লাইল এক উত্তম নফল ইবাদাত, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় এবং জান্নাতের বিশেষ পুরস্কারের মাধ্যম।
আরাফার দিন
আরাফার দিন বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি। এই দিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহর কাছে এমন কোনো দিন নেই যেদিন তিনি আরাফার দিনের চেয়ে অধিকসংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। তিনি তাঁর বান্দাদের নিকট আসেন এবং ফেরেশতাদের সামনে তাদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘এরা কী চায়?’” [সহীহ মুসলিম, হাদীস 1348]। আর আরাফার দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আরাফার দিনের রোযা বিগত এক বছর এবং আগত এক বছরের গুনাহ মাফের কারণ হয়।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস 1162]।
আরাফার দিন আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। তিনি বান্দাদের নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন এবং বলেন, “এরা কী চায়?”— “مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللَّهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَإِنَّهُ لَيَدْنُو، ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمُ الْمَلَائِكَةَ، فَيَقُولُ: مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ؟” [সহীহ মুসলিম, হাদীস 1348]। এদিন শয়তান সবচেয়ে বেশি অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়, কারণ হজ্জের ময়দানে মানুষ তাওবাহ করে আর যারা উপস্থিত হতে পারেনি, তারাও সিয়াম রেখে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “আরাফার দিনের রোযা বিগত এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায়”— “صَوْمُ يَوْمِ عَرَفَةَ، يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ” [সহীহ মুসলিম, হাদীস 1162]। হাফসাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, “চারটি আমল রাসূল ﷺ কখনোই ত্যাগ করতেন না— আশুরার রোযা, জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের রোযা, প্রতি মাসে তিনটি রোযা এবং ফজরের আগে দুই রাকাআত সালাত”— “أَرْبَعٌ لَمْ يَكُنْ يَدَعُهُنَّ النَّبِيُّ ﷺ…” [সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস 2416]।
৯) ১০ ই জিলহজ্জ ও পশু কুরবানি
আসমান-জমিন ও দিন-রাতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কিছু দিনকে অন্য দিনের তুলনায় বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ন দিন হলো ১০ই জিলহজ্জ, যেদিন পশু কুরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে। কুরবানি হলো আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহিদ) ঘোষণা এবং তাঁর প্রশংসার এক মহৎ নিদর্শন। এটি মহান নবী ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আমল অনুসরণের প্রতীক, যিনি পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত সম্পূর্ণ করেছিলেন।
১০ই জিলহজ্জ থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৩ই জিলহজ্জ পর্যন্ত কুরবানির মাধ্যমে আমরা এই মহান আমল সম্পাদন করতে পারি। এই আমল শুধু হাজ্জীদের জন্য নয়, যারা হাজ্জে যাননি তারাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন: “তাহলে, আপনার রবের জন্য নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।” (সূরা আল-কোরআন, সুরা কাবা: আয়াত ২)
আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন: “বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু আল্লাহ, জগতের রবের জন্য।” (সূরা আল-কোরআন, সুরা আন‘আম: আয়াত ১৬২)
এই আয়াতগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কুরবানি শুধুমাত্র পশু নিক্ষেপের কাজ নয়, এটি হলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ইবাদতের এক উৎকৃষ্ট রূপ। ১০ই জিলহজ্জের এই আমল আমাদের ঈমানকে দৃঢ় করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে। তাই আমাদের উচিত এই পবিত্র দিনে কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।
কুরবানির হুকুম নিয়ে আলিমগণের মাঝে মতপার্থক্য আছে। কিছু সংখ্যক আলিম বলেন—কুরবানি ওয়াজিব, তবে অধিকাংশ আলিমের (জুমহুর) মত হলো—এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, অর্থাৎ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ যা সামর্থ্যবানদের জন্য না করাটা মারাত্মক গাফেলতির শামিল। এই গুরুত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিস থেকেও স্পষ্ট: “যার কুরবানির সামর্থ্য আছে অথচ সে কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের দিকে না আসে।” (ইবনে মাজাহ: ৩১২৩)
সুতরাং সামর্থ্য থাকলে কুরবানি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। কুরবানি দেওয়ার সময় নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া মুস্তাহাব: “بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَر، اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّي وَمِنْ أَهْلِ بَيْتِي”
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি ওয়া মিন আহলি বাইতি।
অর্থ: “আল্লাহর নামে (কুরবানি করছি), আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আল্লাহ! আমার পক্ষ থেকে এবং আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন।”
সকল বরেণ্য আলিম একমত যে, কুরবানির পশু কিনে তা সাদাকাহ করে দেওয়ার চেয়ে নিজ হাতে কুরবানি করা উত্তম। কারণ কুরবানি একটি নির্দিষ্ট ইবাদত যা কেবল দান নয়, বরং তা আত্মত্যাগের বহিঃপ্রকাশ এবং সুন্নাহর অনুসরণ।
উট বা গরুর কুরবানিতে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারে। ঘরের কর্তা নিজে এবং তার অধীনস্থ স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ থেকেও কুরবানি করতে পারেন, যেমন সাহাবায়ে কিরাম ও সালাফে সালেহীন করতেন।
যে ব্যক্তি কুরবানির নিয়ত করেছে, তার জন্য করবানি সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত নখ ও চুল না কাটাই উত্তম। কুরবানির গোশতের একাংশ নিজে খাবে, একাংশ আত্মীয়দের দেবে, আর একাংশ গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করবে—এটাই কুরবানির প্রকৃত আদব।
এমনটা বাধ্যতামূলক নয় যে কুরবানির জন্য আপনাকেই নিজ হাতে জবেহ করতে হবে, তবে এটাই সর্বোত্তম। আপনি কেবল তত্ত্বাবধানে থাকতে পারেন অথবা অপারগ হলে কাউকে দায়িত্ব দিয়েও করাতে পারেন।
কুরবানি অবশ্যই হতে হবে ঈদুল আযহার সলাতের পরে; আর হাতে সময় পাবে পরের তিনদিন (১৩ই জিলহজ্জ পর্যন্ত)। যারা ঈদের সলাতের আগেই কুরবানি করে ফেলেছিল, তাদেরকে রাসূলুল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তারা আবার কুরবানি করে।
১০) তাওবাহ
রাসূলুল্লাহর অনুসরণে প্রতিদিনই তাওবাহ করা উচিত। আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালোবাসেন। [সূরা আল-বাকারা: ২২২]
নাবি মুসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয় যেখানে তিনি তার সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দুআ করছিলেন। আল্লাহ আযযাওয়াজাল মুসাকে (আলাইহিস সালাম) বললেন, তাঁর সাথে উপস্থিতদের মাঝে এমন একজন আছে যে চল্লিশ বছর যাবত গুনাহ করেই যাচ্ছে এবং তখনও সে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আছে।
মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর কওমের দিকে ফিরে বললেন, সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই বের হয়ে যেতে হবে। কারণ তার কারণেই দুআ কবুল করা হচ্ছে না। ঐ গুনাহগার লোকটি তখন নীরবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো, যাতে তার গুনাহগুলো গোপন রাখা হয় যেভাবে আল্লাহ ৪০ বছর যাবত সেগুলো গোপন রেখেছেন; এবং তাকে যাতে ক্ষমা করা হয়।
আল্লাহ আযযাওয়াজাল দেখলেন লোকটির তাওবাহ আন্তরিক। তখনই আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করলেন এবং বৃষ্টি দিলেন। মুসা (আলাইহিস সালাম) অবাক হয়ে গেলেন, ‘কেউ বের হয়ে যাওয়ার আগেই কেন বৃষ্টি হচ্ছে?’ আল্লাহ আযযাওয়াজাল উত্তরে বললেন, ‘ঐ ব্যক্তির তাওবাহ কবুল করা হয়েছে এবং তার পাপ ক্ষমা করে।
১১) সাধারণ সুন্নাহ ও নফল সলাত
প্রতিদিন ১২ রাকাআত সুন্নাহ সলাতের জন্য আপনি জান্নাতে একটি প্রাসাদ পাবেন। রাসূলুল্লাহ তো বেশি বেশি সালাত আদায় করার তাগিদ দিয়েছেন। কারণ আমরা যতবার আল্লাহ আযযাওয়াজালের সামনে সিজদায় ঝুঁকি, এটি আমাদের একটি করে গুনাহ বঝরিয়ে দেয়। আর যতবার সিজদাহ থেকে উঠি, আল্লাহ তা’লা আমাদের আমলনামায় একটি করে সাওয়াব যোগ করে দেন। আমি আল্লাহ আযযা ওয়াজালের কাছে আমাদের যাবতীয় ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং দুআ করছি যেন আমরা তাঁর রহমত এবং ক্ষমা লাভের জন্য জিলহজ্জের পবিত্র দিনগুলোর সুযোগ নিতে পারি। আমিন।